শিশুদের বের করে গৃহবধূকে তালাবদ্ধ করে নির্যাতন

নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলায় এক গৃহবধূকে বিতাড়িত করতে গত তিন মাস ধরে স্বামীর বাড়িতে নির্যাতন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ২৫ বছর বয়সী ওই গৃহবধূর নাম আমিনা বেগম। বর্তমানে তার দুই শিশুকন্যাকে কৌশলে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির ভেতরে অবস্থান করা মায়ের কাছে তাদের যেতে দেওয়া হচ্ছে না।

এ ঘটনার প্রতিকার চেয়ে গৃহবধূর মা লাইলি বেগম থানায় মামলা করতে গেলে মামলা নেয়া হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে। গৃহবধূর অভিযুক্ত স্বামী ফারুক ইসলাম থাকেন ব্রুনাইয়ে। উপজেলার নজিপুর পৌরসভার হরিরামপুর পশ্চিমপাড়ায় এই আদম ব্যপারীর বাড়ি।

গৃহবধূর পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আট বছর আগে ধামইরহাট উপজেলার আলমপুর ইউনিয়নের ভেড়ম সোনাদিঘী গ্রামের ফারুকের সঙ্গে পত্নীতলার আকবরপুর ইউনিয়নের বনী গ্রামের আমিনার বিয়ে হয়। মেয়ের সুখের কথা ভেবে বিয়ের সময় ২ লাখ যৌতুকও দিয়েছিল আমিনার পরিবার। ব্রুনাইয়ে চাকরি দেয়ার নামে এলাকার বিভিন্ন মানুষকে নিয়ে যান ফারুক। এর মধ্যে অনেকেই প্রতারিত হয়ে ফিরে এসেছেন।

কয়েক বছর আগে শ্বশুরবাড়ি থেকে ২৯ লাখ টাকা নিয়ে পত্নীতলা উপজেলার নজিপুর পৌরসভার হরিরামপুর পশ্চিমপাড়ায় জমি কিনে চারতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন ফারুক। দেশে এলে স্ত্রীকে নিয়ে এই বাড়িতেই থাকতেন তিনি। এর মধ্যে ফারহানা ফিন্নি ও ফারিয়া আক্তার রাখি নামে তাদের দুই কন্যার জন্ম হয়। তাদের বয়স যথাক্রমে ৬ ও ৩ বছর। এ ছাড়া ওই বাড়িতে ফারুকের শাশুড়ি ও শালিকাও বসবাস করতেন।

সর্বশেষ তিন বছর আগে দেশে এসেছিলেন ফারুক। এক বছর আগে এক ব্যক্তিকে বিদেশ নিয়ে যান তিনি। অভিযোগ উঠেছে, বিদেশে নিয়ে যাওয়া ওই ব্যক্তির স্ত্রীর সঙ্গে মোবাইলে পরকীয়া শুরু করেন ফারুক। এরপর থেকেই সংসারে অশান্তি শুরু। বিদেশ থেকেই স্ত্রীকে মোবাইলের মাধ্যমে তালাক দেন তিনি। গত তিন মাস ধরে ছেলের নির্দেশে ওই বাসায় অবস্থান করছেন ফারুকের মা। আমিনাকে ওই বাড়ি থেকে বের করে দিতে চায় ফারুকের পরিবার।

কিন্তু আমিনা নাছোড়বান্দা। শ্বশুরবাড়ির লোকজন একের পর এক নির্যাতন চালালেও বাড়ি ছেড়ে যেতে তিনি নারাজ। এ অবস্থায় একটি কৌশল বেছে নেয় ফারুকের পরিবার। গত সোমবার আমিনার দুই কন্যা নানির সঙ্গে বাড়ির বাইরে দোকানে গেলে বাসার মূল দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। কিছুক্ষণ পর কন্যারা ফিরে আসলেও তাদের আর বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, কন্যাদের টানে আমিনা বাড়ির বাইরে এলেই তার জন্য ওই বাড়ির দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। কন্যাদের বাইরে রাখার প্রতিবাদ করার কারণে শাশুড়ি, দেবর-ননদ ও ম্যানেজার বেলাল আমিনাকে মারধর করেন। এতে আমিনার নাক ফেটে গেলেও তাকে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়নি।

বিষয়টি নিয়ে ইতোপূর্বে সালিশ বৈঠক করেছেন উপজেলা চেয়ারম্যান। সেখানে খাওয়া পরা ও মেয়েদের পড়াশুনা বাবদ ফারুক মাসে ১২ হাজার টাকা দেবেন এমন সিদ্ধান্ত হয়। আর ফারুক দেশে আসার পর তালাকের বিষয়টি সুরাহা হবে বলেও জানিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু গত তিন মাসে কন্যাদের জন্য মাত্র ৫ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন ফারুক।
গৃহবধুর মা লাইলি বেগম আরটিভি নিউজকে বলেন, মেয়ের সঙ্গে আমাকে থাকার জন্য জামাই অনুরোধ করেছিল। পরে নিজের জায়গা জমি বিক্রি করে প্রায় ২৯ লাখ টাকা দিয়ে নজিপুর শহরে জমি কেনা ও বাসার কাজে খরচ করা হয়। গত চার বছর মেয়ের সঙ্গে ছিলাম। কিন্তু গত তিন মাস ধরে আমার মেয়ের ওপর তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন নির্যাতন করছে। দুই নাতনি মায়ের কাছে যেতে পারছে না। তাদের বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। নাতনিরা আমার কাছে অনেক কান্নাকাটি করছে। থানায় অভিযোগ দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু অভিযোগ নেয়নি। আমি এর সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।

ভুক্তভোগী আমিনা বলেন, স্বামীর পরকিয়ায় জড়িত হবার পর থেকে সংসারে অশান্তি শুরু হয়েছে। স্বামী এখন বিদেশে। কিন্তু কয়েকদিন আগেও স্বামী তার ম্যানেজার বেলালের মাধ্যমে পরকিয়ার ওই মহিলা নিপাকে আমার বাসায় জোর করে রাখে। কারণে অকারণে আমাকে শ্বশুরবাড়ির লোকজন নির্যাতন করছে। পুলিশকে ফোন করেছিলাম কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আমার জীবন নিয়ে শঙ্কায় আছি। আমার দুই মেয়ে আমার কাছে আসতে পারছে না। সবকিছু জানার পরও প্রশাসন কেন চুপ আছে। কেন আমার পাশে দাঁড়াচ্ছে না।

আমিনার শ্বাশুড়ি ফাতেমা বেগম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ছেলে বিদেশ থাকে। ছেলের কথায় তিন মাস থেকে তার বাসায় থাকছি। ছেলের বউকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি। বরং আমাকেই মারপিট করেছে। এ ছাড়া আমার ছেলে অন্য কোনো মেয়ের সাথে পরকীয়া করে না।

বাসার মূল দরজায় তালা, নাতনীদের স্কুলে যেতে না দেওয়া ও খাবার দেওয়া হয় না এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, দরজা খোলায় আমার ছেলের নিষেধ আছে। এর বেশি কিছু বলতে চাই না। স্থানীয় বাসিন্দা রুবেল হোসেন বলেন, মোবাইলে তালাক দিলেই কি তালাক হয়? তালাকের আইন আছে। বেশ কিছুদিন ধরে আমিনা বেগমের কান্না ও চিৎকার শোনা যাচ্ছে। বাসায় কিছুদিন থেকে ফারুকের মাও আছে। ছেলে যা বলে তিনি তাই করেন।

জান্নাতুন বেগম নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আমিনা বেগমের দুই মেয়েকে কয়েকদিন ধরে বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। এটা কী ধরনের নির্মম কাজ। এর একটা বিহিত দরকার। পত্নীতলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল গাফফার বলেন, তিন মাস আগে ওই পরিবারের উভয়পক্ষকে নিয়ে বসে বাচ্চাদের ভরণপোষণ ও পড়াশুনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। তারা মেনেও নিয়েছেন। এ ছাড়া ওই গৃহবধূর স্বামী যেহেতু বিদেশে থাকেন, তাই তিনি দেশে ফিরে আসলে তারা তাদের মতো সিদ্ধান্ত নেবেন।

এ সময় দুই কন্যাকে বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়া এবং থানায় অভিযোগ না নেয়ার বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলেও জানিয়েছেন চেয়ারম্যান। বিষয়টি নিয়ে পত্নীতলা থানার ওসি শামসুল আলম শাহ বলেন, ওই পরিবারের বিষয়ে থানায় লিখিত কোনো অভিযোগ দেয়া হয়নি। গৃহবধূকে নির্যাতন করা হয়েছে জানিয়ে তার মায়ের মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে ঘটনাস্থলে দুই পুলিশ সদস্য পাঠানো হয়েছিল। তখন সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। তবে দুই পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ করেছে। আমরা তাদের শান্তভাবে বসবাসের অনুরোধ করেছি। লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।